তৎকালীন বঙ্গীয় অঞ্চলে জমিদারী ও নবাবী শাসনকালীন সময়ে রাজস্ব আদায়ের জন্যে বাৎসরিক একটি বন্দবস্ত ও উৎসবের নাম পুণ্যাহ। বর্তমানে এটি একটি বিলুপ্ত ও ইতিহাসে নাম সর্বস্ব উৎসব হিসেবে পরিচিত।
এই উৎসবটি বিলুপ্ত হলেও এটার আঙ্গিকে এখনো গ্রাম গঞ্জে হালখাতা নামে একটি অনুষ্ঠান করা হয় । সেখানে উৎসবের আমেজ না থাকলেও আনুষ্ঠানিকতা থাকে বেশ।
পুণ্যাহ ছিল রাজস্ব আদায় এবং বন্দোবস্ত সংক্রান্ত বিষযের প্রাক-ব্রিটিশ সময়ের একটি পদ্ধতি। যে ব্যবস্থায় সরকার কর্তৃক সকল জমিদার, তালুকদার, ইজারাদার এবং অন্যান্য রাজস্ব প্রদানকারী ব্যক্তিদের বছরের নির্দিষ্ট দিনে একটি অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণের মাধ্যমে পূর্ববর্তী বছরের রাজস্ব আদায় এবং নতুন বছরের বন্দোবস্ত প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো।
ইতিহাসে সওয়ার করে জানা যায়, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে পুণ্যাহ উৎসব বাংলা নববর্ষের সমার্থক হিসেবে প্রতি বছর বাংলা বছরের প্রথম দিন অর্থাৎ বৈশাখ মাসের ১ তারিখে নিয়মিতভাবে পালন হয়ে আসছে।১৯৫০ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলোপ পাশাপাশি পুণ্যাহ উৎসবের বিলুপ্তি ঘটে।
এখন কালের পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে পুণ্যাহ উৎসব কিন্তু পুন্যাহের আদলে যে হাল খাতা অনুষ্ঠিত হয় সেখানে নিশ্চুপ বেঁচে আছে ঐতিহ্যবাহি এই উৎসবটি।
পুণ্যাহ যেমন বিলুপ্ত প্রায় উৎসব এবং পুণ্যাহর বিবর্তনই যে এখন হালখাতা সেটা জানাবো আজকের ইতিহাস ভিত্তিক আলোচনায়। আমরা এও জানবো বিবর্তিত হালখাতাও আজ বিলুপ্তির পথে কি না!
ইতিহাস বলে পুণ্যাহের গর্ভেই এসেছে হালখাতা । নওয়াব দরবার পরিচালিত পুণ্যাহ অনুষ্ঠানে যে সকল ব্যক্তিগণ নওয়াব কে সন্তুষ্ট করতে পারতো তাদেরকে সম্মানসূচক খিলাত বা পোশাক দান করা হতো।
এইভাবে জমিদারগণ ও অন্যান্য ভূস্বামীগণ তাদের রায়ত বা প্রজাবর্গকে নিয়ে পুণ্যাহ অনুষ্ঠান পালন করতেন। রায়ত গণ বিগত বছরের বকেয়া রাজস্ব পরিশোধ করতেন এবং নতুন বছরের বন্দোবস্ত গ্রহণ করতেন।
রায়তগণ জমিদারের কাচারিতে একত্রিত হয়ে জমিদার অথবা তার নাযেবের নিকট থেকে পান বা পানপাতা গ্রহণ করতেন। এ উপলক্ষে নৃত্য, সঙ্গীত, যাত্রাপালা, গবাদি পশুর দৌড়, মোরগ যুদ্ধ এবং বিভিন্ন বিনোদনমূলক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। মুঘল আমলে পুণ্যাহ উৎসবের কোনো নির্দিষ্ট তারিখ ছিল না।
যখন থেকে এই উৎসব রাজস্ব বন্দোবস্ত এবং রাজস্ব সংগ্রহের সাথে যুক্ত হলো, তখন থেকেই পুণ্যাহ উৎসবের তারিখ নির্ধারিত করা হলো। মূলত প্রধান ফসল তোলার সময়কে সাধারণভাবে এই উৎসবের জন্যে নির্ধারিত করা হতো। এ বিষয়ে মুর্শিদকুলী খান একটি নতুন রীতি প্রচলন করেন।
এই রীতি অনুসারে চৈত্র মাসে (বাংলা সনের শেষ মাস, এর অনুরূপ ইংরেজি সালের মাস হলো মার্চ-এপ্রিল) ফসল তোলা শেষ হওয়ার পর পুণ্যাহ উৎসব পালন করা হতো। উৎসব শেষে সংগৃহীত রাজস্ব ভারতের দিল্লিতে প্রেরণ করা হতো। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসল উৎপাদন হ্রাস পেলে পুণ্যাহ উৎসবেই রাজস্ব মওকুফের সিদ্ধান্ত গৃহীত হতো।
পুণ্যাহ বলতে সমস্ত রাজস্বের আদায়কে বোঝাত না; অনাদায়কৃত রাজস্ব মওকুফ কিংবা ভবিষ্যতের জন্য স্থগিত করার ব্যবস্থাও এই উৎসবে করা হতো। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে রায়ত গণ বকেয়া রাজস্ব মওকুফ পেত। এছাড়াও, চাষাবাদের জন্যে তাদেরকে তাকাবি বা ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করা হতো, পুণ্যাহ উৎসবে সে সকল ঋণের লেনদেনও সম্পন্ন করা হতো।
১৭৬৬ সালে, ইংরেজদের দেওয়ানী লাভের পর, প্রথম পুণ্যাহ উৎসব অনুষ্ঠিত হয় মুর্শিদাবাদ কোর্টে ইংরেজদের রাজনৈতিক আবাসস্থল মতিঝিলে। লর্ড ক্লাইভ এ উৎসবের সভাপতিত্ব করেন।
তিনি এর প্রতি বিশেষ গুরূত্ব আরোপ করেছিলেন এবং প্রতিবছর এ উৎসব পালনের পক্ষে ছিলেন। তবে কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স ফোর্ট উইলিয়ম সরকারকে এ পুণ্যাহ উৎসব পালন না করার নির্দেশ দেন।
চলে গেছে ইংরেজরা,নেই আর জমিদারী বা নবাবী শাসন ব্যাবস্থাও।তাই হারিয়ে গেছে জমিদার,নবাব বা ইংরেজদের রাজস্ব আদায়ের ব্যাবস্থা পুণ্যাহ উৎসব।
তারপর শুরু হয় মহাজনি ঋণ ও গ্রাম গঞ্জের বড় বড় দোকানীদের থেকে এক শ্রেণীর আস্থাভাজন ক্রেতা ও পাইকারি ক্রেতাদের বকেয়া মালামাল খরিদ করার ব্যবস্থা।
এক মাত্র পাইকারি ব্যাবসায়িরা ছাড়া অন্যান্য ক্রেতারা নেহায়েত বিপদে না পরলে বাকিতে মাল পত্র কেনে না কেউ। যারা এমন বাকিতে মালপত্র কেনে তাদের থেকে বছরের বৈশাখের ১ তারিখ থেকে শুরু করে পুরো মাস বকেয়া আদায়ের জন্যে যে আনুষ্ঠানিকতা পালন করে।
মহাজন ও দোকানীরা সেই আনুষ্ঠানিকতাই মূলত হালখাতা নামে পরিচিত। বকেয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে হালখাতা অনুষ্ঠানে মহাজন ও দোকানিরা তাদের ক্রেতা ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের জন্যে রাখে হালকা খাবার ব্যাবস্থা থেকে ভুরি ভোজের ব্যাবস্থাও ।
হালখাতার দিন সকাল থেকেই দোকানিরা সকল কাজ বন্ধ রেখে বকেয়া পরিশোধ করতে আসা ক্রেতাদের আপ্যায়নে ব্যাস্ত থাকে।ক্রেতারা বকেয়া পরিশোধ করে, খাওয়া দাওয়া শেষ করে তৃপ্তির হাঁসি নিয়ে পান মুখে বাড়ির পথ ধরে।
এখনো গ্রাম গঞ্জে হালখাতার দিনে সারা দিন মাইক বাজিয়ে গান বাজনা চালানো হয়, দূর দুরান্তের মানুষকে মনে করিয়ে দেওয়ার ব্যাবস্থা করা হয় ।
অবশ্য হালখাতার প্রায় দিন পনের আগেই চিঠির মাধ্যমে মহাজন ও দোকানিরা বকেয়াধারী ক্রেতাদের জানিয়ে দেয় তাদের বাকির সম্ভাব্য হিসেব।
এই চিঠিতেও পাওয়া যায় বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি ও কৃষ্টির ছোঁয়া। সময়ের সাথে ইতিহাসে সওয়ার হয়ে আর পরিবর্তনের খোচায় পুণ্যাহ বিলুপ্ত হয়ে হালখাতায় পরিনত হয়েছে।
হয়তো এই তথ্য,প্রজুক্তির যুগে পরিবর্তিত হালখাতাও হারাবে তার উৎযাপন,আয়োজন ও প্রয়োজনের রঙ। হালখাতাও পরিনত হবে ইতিহাসে,বিলুপ্তির ইতিহাস হবে সেটাও।