বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের আনন্দ-মুখর দিনগুলো একজন শিক্ষার্থীর সারা জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় কিম্বা সুখের স্মৃতি হয়ে থাকতে পারে। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে যে ডিগ্রি নিচ্ছেন সেটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু একই সাথে প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাস, পড়াশোনার পরিবেশ এসবও আমাদের জীবনের নানা পর্যায়ে প্রভাব ফেলে।
জ্ঞান-বিজ্ঞান বিকাশে পৃথিবীর নানা দেশে নানা সভ্যতায় গড়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়। পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লেখাপড়া করার স্বপ্ন বুকে লালন করেন শত শত মেধাবী তরুণ। অনেকে হয়তো তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারেন, অনেকে আবার পারেন না। তবে প্রত্যেকের মধ্যেই পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পর্কে জানার আগ্রহ থাকে।
শিক্ষা, গবেষণা, শিক্ষক–শিক্ষার্থী অনুপাত ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের মতো কয়েকটি মানদণ্ডে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মূল্যায়ন করে প্রতি বছর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকা করা হয়, কিন্তু কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেগুলো বিশেষ কিছু কারণে বিখ্যাত হয়ে আছে।
প্রাচীন মানুষ কবে থেকে পৃথিবীতে জ্ঞান চর্চা শুরু করেছিল তা বলা মুশকিল। তবে আদি কাল থেকেই জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে কৌতূহলী ছিল মানুষ, তাইত তৈরি করেছিল সর্বোচ্চ জ্ঞান চর্চার প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়।
মরক্কোর ফেস নামক স্থানে ৮৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আল কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়কে পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়। গিনিস বুকে এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃত। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল মুসলিম বিশ্বে নেতৃত্বদানকারী অন্যতম একটি আধ্যাত্মিক ও শিক্ষাবিষয়ক কেন্দ্র। এটি মূলত ইসলাম শিক্ষাবিষয়ক ধর্মভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়। মধ্যপ্রাচ্যে আল-কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়টি ইসলামিক বিশ্ব এবং ইউরোপের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বর্তমানেও এটি চালু আছে।
অন্যদিকে ৯৭২ খ্রিস্টাব্দে মিসরের কায়রোতে স্থাপিত 'আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়'কেও বিশ্বের প্রথম ও প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানের চর্চা অব্যাহত রয়েছে।
অন্যদিকে পৃথিবীর প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে অভিহিত করা হয় ভারতের বিহারে ৫০০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত 'নালান্দা বিশ্ববিদ্যায়'-এর নাম। ইতিহাসের প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে নালান্দা অন্যতম। ৫০০ থেকে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৮০০ বছর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলেছিল।
ইউরোপের সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচনা করা হয় ১০৮৮ সালে ইটালির উত্তরাঞ্চলীয় শহর বোলোনিয়াতে চালু হওয়া বোলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে। ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টার, লাল ছাদের বিল্ডিংগুলো আর আকাশ্চূম্বী সব পিলার মিলিয়ে এই ক্যাম্পাসকে করে তুলেছে বিশ্বের অন্যতম সুন্দর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোর একটি।
যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। স্বপ্নময় গম্বুজ আর সোনালি পাথরের এই বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়েছিল ১০৯৬ খ্রিস্টাব্দে। এখনও পর্যন্ত ব্রিটেনের ২৮ জন প্রধানমন্ত্রী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করা প্রথম ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আর্ল অফ উইলমিংটন, ১৭৪২ সালে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনও পড়াশোনা করেছেন অক্সফোর্ডে ।
জনসংখ্যার হিসেবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ ভারতে ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল ওপেন ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী। ভারতের একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রীর নামে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুসারে ২০২০ সালে এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছিল ৫০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী। ভারত ছাড়াও সারা বিশ্ব থেকেই শিক্ষার্থীরা এখানে পড়াশোনা করেন। মূলত দূর-শিক্ষণ বা সশরীরে উপস্থিত না হয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করা যায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে।
অপরদিকে শিক্ষার্থীর বিবেচনায় ২য় যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া কমিউনিটি কলেজে প্রায় ২০ লাখের বেশি ছাত্রছাত্রী শিক্ষা গ্রহণ করেন।
আমেরিকার বিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় প্রতি বছরই পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালগুলুর মধ্যে স্থান পেয়ে থাকে। পৃথিবীর জ্ঞানী গুণী মানুষের তীর্থস্থান যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের সবচেয়ে ধনী বা সমৃদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত। ২০২০ সালের হিসেব অনুসারে ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের এই বিশ্ববিদ্যালয়টির মোট অর্থের পরিমাণ ছিল ২৫০০ কোটি ডলারের বেশি।
অদ্ভুত স্থানে অবস্থানের বিবেচনায় প্রথম হতে পারে গ্রাব্রক আগ্নেয়গিরি উপত্যকায় অবস্থিত আইসল্যান্ডের বিফ্রস্ট বিশ্ববিদ্যালয়। ব্যবসা, আইন ও সমাজ বিজ্ঞান পড়ার জন্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়টির পরিচিত। আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের দিকে দ্রুত হেঁটে গেলে শিক্ষার্থীরা প্রায় এক ঘণ্টার মধ্যে এর চূড়ায় উঠে আবার নেমে আসতে পারেন।
পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নাম মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি। রাশিয়ার এ বিশ্ববিদ্যালয় ১৭৫৫ সালে বানানো হয়। উচ্চতা ৭৮৭ ফুট। গুনে গুনে ৪২টি তলা আছে। বিশ্ববিদ্যালয় হলেও এতে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা কার্যক্রমও রয়েছে।
অন্যদিকে টোকিওর ৬৬৯ ফুট উঁচু মড গাকুয়েন কোকুন টাওয়ার পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ৫০ তলা ভবনের এ প্রতিষ্ঠানে তিন ভাগে পড়াশোনা চলে। এর মধ্যে আছে ফ্যাশন ভোকেশনাল স্কুল, প্রযুক্তি ও ডিজাইন কলেজ। একটি মেডিক্যাল কলেজও রয়েছে এর অধীনে।নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়া শতবর্ষের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপমহাদেশের একটি অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নানা পটপরিবর্তনের মাধ্যমে জন্ম নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, একসময় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাত ধরেই বাঙালি জাতি লাভ করে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু লোকজনের প্রবল বিরোধিতার মধ্যে ১৯২১ সালের ১ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে প্রতিবাদী চেতনার বিকাশ ঘটতে দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়টিকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলের সমাজ-সংস্কৃতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটতে থাকে। যার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ। সাধারণত দেশ বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করে, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ তৈরি করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বাঙালি জাতির ইতিহাস। বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ের সঙ্গে এই বিশ্ববিদ্যালয় জড়িত।