বৈশ্বিক তাপমাত্রা যেভাবে বাড়ছে, তাতে হিমালয়ের হিমবাহগুলোর জন্য হুমকি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে যাচ্ছে।
জমাট বাধতে পারছে না পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের হিমবাহগুলো৷ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে হিমালয় থেকে নেমে আসা নদীগুলো৷ নদীগুলোর ওপর নির্ভর করছে তিনশ' কোটি মানুষের পানির জোগান৷
পানির স্রোত কমে যাওয়ায় সংকটে পরতে যাচ্ছে নদীগুলোর ওপর নির্ভরশীল ভারত ও বাংলাদেশের মানুষ৷ সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে পর্যটন ও তীর্থযাত্রাকে হিমালয়ের নগরায়ণ বৃদ্ধির নেপথ্য কারণ বলা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অপরিকল্পিত নগরায়ণ বেড়ে যাওয়ায় ঝরনা ও নদীনির্ভর পানি ব্যবস্থাপনার প্রতি নির্ভরতাও বেড়েছে।
অপরিকল্পিত নগরায়ণ বেড়ে যাওয়ায় ওই অঞ্চলে মারাত্মকভাবে বেড়েছে জনসংখ্যা। যে কারণে সেখানকার পানির উৎসগুলোর অতি ব্যবহার ঘটছে, যা বাসিন্দাদের ক্রমেই ঠেলে দিচ্ছে এক হতাশাজনক পরিস্থিতির দিকে।
বাংলাদেশের বান্দরবান, ভারতের জম্মু ও কাশ্মির, সিমলা, হরিদুয়ার, হৃষিকেশ, দার্জিলিং ও দেশটির উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের রাজ্যগুলো, নেপালের বেশিরভাগ অঞ্চল এবং পাকিস্তানের হিমালয় পর্বত অঞ্চল হিমালয়কেন্দ্রিক বড় পর্যটন কেন্দ্রগুলোর অন্যতম।
এই সকল অঞ্চলের ঝরনা কিংবা গভীর বা অগভীর কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করাটাই এখন পর্যন্ত পানির চাহিদা পূরণের উপায় হিসেবে গণ্য হচ্ছে।
যদি যথাযথ পরিমাণে ও যথাযথভাবে পরিকল্পিত পানি সংগ্রহের ব্যবস্থা তৈরি করা না যায় তাহলে ভূগর্ভের পানির ওপর এই অত্যধিক নির্ভরতা ভবিষ্যতে আরও খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করবে।
হিমালয়ের কাছাকাছি অবকাঠামো নির্মাণাধীন এলাকা থেকে প্রচুর ধুলা এসে পড়ায় বরফ আগের মতো সূর্যকিরণ প্রতিফলিত করতে পারছে না। ধূলিকণাগুলো হিমবাহ পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। ফলে এখন আর বরফের স্তরগুলোকে আগের মতো সাদা মনে হয় না। এই ধূলিকণা খুবই বিপজ্জনক। এরা তাপ শুষে নেয় এবং বরফ খুব দ্রুত গলতে বাধ্য করে।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের হিমালয় রাজ্য উত্তরাখন্ডে ঘটে যাওয়া আকস্মিক বন্যা আর কেদারনাথের বিপর্যয়ের মতো বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এখানে জলবায়ু পরিবর্তন এবং দুর্বল পরিকাঠামোর কারনে সামনের দিনগুলোতে এ ধরনের আরো দুর্যোগের বিষয়ে সতর্ক বার্তা দিচ্ছে বিশেষজ্ঞরা।
পুরো হিমালয় অঞ্চল ছড়িয়ে আছে ৪২ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে, যা আটটি দেশের মধ্যে পড়েছে। বাংলাদেশ ছাড়া অন্য দেশগুলো হলো: আফগানিস্তান, ভুটান, চীন, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল ও পাকিস্তান। পর্বত অঞ্চলে সংস্থান হয় প্রায় ২৪ কোটি মানুষের জীবিকা। অঞ্চলটিতে রয়েছে ১০টি বড় নদীর উৎপত্তিস্থল এবং বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে স্বীকৃত ৩৬টি প্রাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ স্থান।
জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক নতুন একটি গবেষণা প্রতিবেদনে সম্প্রতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত কয়েক বছরে ভারত ও নেপালে অবস্থিত বিভিন্ন হিমবাহের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে।
২১০০ সাল নাগাদ এই হিমবাহের অর্ধেক গলে নিঃশেষ হবে। এর ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্ভরশীল ১৬৫ কোটি মানুষের জীবন ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
প্রথমে প্রবল বন্যা, আর তারপর অন্তহীন খরা—পুরো হিমালয়ের প্রভাববলয়ে থাকা মানুষের জীবনে এটিই ভবিতব্য হতে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে কার্বন ডাই–অক্সাইড নিঃসরণ দ্রুত কমানো না গেলে হিমালয়-হিন্দুকুশ হিমবাহের দুই-তৃতীয়াংশ বরফ গলে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। এখানে বৃষ্টিপাতের ধরনও বদলে গেছে। এতেও ক্ষতি হচ্ছে অনেক।
হিমালয় পর্বতমালার হিন্দু কুশ অঞ্চল ১০টি বড় নদীর উৎপত্তিস্থল। গত কয়েক দশকে জনসংখ্যা বাড়ছে হিন্দু কুশ অঞ্চলের দেশগুলোতে। ফলে বেড়েছে নিরাপদ পানির চাহিদা। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও দুর্বল পানি ব্যবস্থাপনার কারণে এ চাহিদা পূরণে হিমশিম খাচ্ছে এ অঞ্চলের দেশগুলো।
হিন্দু কুশ অঞ্চলের ১৩টি শহরে আগামীতে বিশুদ্ধ পানি সংকট দেখা দেবে। এরমধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও তিন পার্বত্য জেলা এবং সিলেট অঞ্চল।
আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই হিমালয়ের বরফ গলা আরও বাড়তে পারে। কারণ, ক্রমবর্ধমান বায়ুদূষণ ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাড়ছে বৈ কমছে না।
হিমালয়ের মতো অঞ্চলে, যেখানে তাপমাত্রার বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর, এখানে দ্রুত তুষার গলে যাওয়ার মতো ঘটনাগুলো অত্যন্ত বড় ধরনের প্রাকৃতিক ঘটনা। এমনকি তুষার খরার মতো ঘটনা সামগ্রীকভাবে কমে গেলে তা পরবর্তীতে বড় ধরনের বন্যার জন্ম দিতে পারে। এতে এশিয়ার তিনটি প্রধান নদী ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ পানির জন্য হিমবাহের ওপর নির্ভরশীল। তাই পৃথিবীর সর্বোচ্চ এই পর্বতশৃঙ্গের হিমবাহ বাঁচাতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।