খাবার মানেই যেন পুরান ঢাকা। আর পুরান ঢাকার প্রতিটি বিখ্যাত খাদ্যের পিছনে লুকিয়ে থাকে যেন নবাবদের ঐতিহ্যের ইতিকথা। এমনই মির্জা আগা বাকির খাঁর প্রেমকাহিনী থেকে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী রুটি বাকরখানির নামকরণ করা হয়েছে।
ঢাকায় এক সময় রাজত্ব ছিল নবাবদের। এসব নবাবরা তাদের পছন্দ মত অনেক নবাবী খাবারের প্রচলন করে গেছেন। যেসব খাবার এখন পুরান ঢাকা বাসিন্দাদের পছন্দের ও প্রচলিত খাবারে পরিণত হয়েছে।
এমনই ঢাকাইয়াদের প্রতিদিনের অন্যতম প্রচলিত খাবার বাকরখানি। পুরান ঢাকা লালবাগের এক স্থায়ী বাসিন্দার থেকে জানা যায়, প্রতিদিন তাদের সকালের নাস্তায় অথবা বিকালে এক কাপ চা এর সাথে বাকরখানি খেতেয় হয়। বাকরখানি ছাড়া তাদের চলেই না।
এ সম্পর্কে পুরান ঢাকা নারিন্দার এক বাকরখানি বিক্রেতা বলেন, ঢাকার বাইরের মানুষ মাসে অথবা সপ্তাহে বাকরখানি খেলেও পুরান ঢাকার মানুষের প্রতিদিন বাকরখানি খেতেই হয়।
পুরান ঢাকার এই ঐতিহ্যবাহী রুটি বাকরখানির নামকরণটি আসে মূলত নবাবদের থেকে। এমনটাই জানা যায় পুরান ঢাকা নারিন্দার এক বাকরখানি বিক্রেতার কাছ থেকে। এছাড়া আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাকরখানি রুটির সৃষ্টি বলে ধারণা করেন স্থানীয় পুরান ঢাকার বাসিন্দারা।
বাকরখানির নামকরণের ইতিহাস সম্পর্কে সঠিকভাবে তথ্য পাওয়া না গেলেও পুরান ঢাকার কেউ কেউ বলেন, নবাবরাই এর প্রচলন করেছেন। নবাবদের খুব পছন্দের খাবার ছিল বাকরখানি। তবে এ সম্পর্কে পুরান ঢাকার এক পুরাতন বাসিন্দা বলেন, নবাব আগা বাকেরের নাম থেকেই বাকরখানি নামের প্রচলন হয়েছে।
পরবর্তিতে সামাজিক মাধ্যম গুগলের উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায়, নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁর দত্তক ছেলে ছিল আগা বাকের। আগা বাকের অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন, এমনকি যুদ্ধ বিদ্যাতেও তিনি অনেক পারদর্শী ছিলেন।
সে সময়ে রাজধানী মুর্শিদাবাদের নর্তকী খনি বেগম এবং আগা বাকের একে অপরের প্রেমে পরেন। কিন্ত উজিরপুত্র নগর কোতোয়াল জয়নাল খান ছিল পথের কাঁটা। সে খনি বেগমকে প্রেম নিবেদন করলে তিনি জয়নাল খানকে প্রত্যাখান করেন। প্রত্যাখ্যাত হয়ে জয়নাল খনি বেগমের ক্ষতির চেষ্টা করে এবং খবর পেয়ে বাকের সেখানে যান ও তলোয়ারবাজিতে জয়নালকে হারিয়ে দেন।
অন্যদিকে জয়নালের দুই বন্ধু উজিরকে মিথ্যা খবর দেয় যে, বাকের জয়নালকে হত্যা করে লাশ গুম করেছে। এরপর উজির তার ছেলের হত্যার বিচার চান।
নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁর পুত্র বাকেরকে বাঘের খাঁচায় নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেন। অবশেষে বাকেরের হাতে মারা যায় বাঘ। ইতিমধ্যে জয়নালের মৃত্যুর মিথ্যা খবর ফাঁস হয়ে গেছে ও সে জোর করে খনি বেগমকে ধরে নিয়ে গেছে দক্ষিণ বঙ্গে। উদ্ধার করতে যান বাকের খনি বেগমকে। পিছু নেন উজির জাহান্দার খান। ছেলে জয়নাল খান বাকেরকে হত্যার চেষ্টা করলে উজির নিজের ছেলেকে তলোয়ারের আঘাতে হত্যা করেন । এই অবস্থাতে জয়নাল খনি বেগমকে তলোয়ারের আঘাতে হত্যা করেন।
বাকেরগজ্ঞে সমাধিস্থ করা হয় খনি বেগমকে। আর বাকের সবকিছু ত্যাগ করে দক্ষিণ বঙ্গে প্রিয়তমার সমাধির কাছে রয়ে গেলেন।বাকের খাঁর নামানুসারেই বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ (পটুয়াখালি-বরিশাল) অঞ্চলের নাম হয় বাকেরগঞ্জ। ঐতিহ্য্যবাহী বাকরখানি রুটির নামের পেছনেও রয়েছে বাকের-খনির প্রেমের ইতিহাস।
অবশ্য নামকরণের ব্যাপারে অন্য আরেকটি জনশ্রুতি রয়েছে। সে অনুযায়ী, মির্জা আগা বাকের ঢাকায় বাকরখানি রুটি প্রচলন করেন। তিনি বৃহত্তর বরিশালের জায়গীরদার ছিলেন। তার প্রেয়সী ছিল আরামবাগের নর্তকী খনি বেগম। তাদের মধ্যে গভীর প্রেম ছিল বলে কথিত আছে।
পরবর্তীতে আগা বাকের ২য় মুর্শিদ কুলি খাঁর কন্যাকে বিয়ে করেন। কিন্তু খনি বেগমের স্মৃতি তিনি ভুলে যান নি। তার আবিস্কৃত এবং প্রিয় খাদ্য বিশেষভাবে তৈরি রুটির নাম তার প্রেমকাহিনীর উপর ভিত্তি করেই নামকরণ করা হয়েছিল বাকের-খনি রুটি। পরবর্তীতে এই নাম কিছুটা অপভ্রংশ হয়ে বাকরখানি নাম ধারণ করে।
বাকরখানি তৈরির জন্য তেল, ময়দা, লবণ আর পানি ছাড়া তেমন কিছুই লাগেনা। বাকরখানি বানানোর আলাদা ময়দা পাওয়া যায় শুধুমাত্র চকবাজারে। এ ময়দা চকবাজার ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া যায়না। চকবাজারে গিয়ে বাকরখানির ময়দা বললেই হয়।
বাকরখানি দুই ধরণের হয়ে থাকে। বাকরখানি আর মিষ্টি বাকরখানি। সাধারণত বাকরখানির মূল্য কেজি প্রতি ১০০ থেকে ১২০টাকা ও ৩ থেকে ৫টাকা করে পিস বিক্রি করা হয়।
ঢাকার প্রায় অনেক জায়গাতেই বর্তমানে বাকরখানি পাওয়া গেলেও পুরান ঢাকার স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, পুরান ঢাকার লালবাগ আর নারিন্দা এলাকায় সবচেয়ে পুরাতন, সুস্বাদু ও বিখ্যাত বাকরখানি পাওয়া যায়।