ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নিষিদ্ধ হয়েছে বোরকা ও নেকাব। পাশ্চাত্যের নারীবাদ বা নারী স্বাধীনতার উদারপন্থী নীতিকে পাশে ঠেলে ইসলাম বিদ্বেষী জনসমর্থন পাবার জন্যে জাতীয়তাবাদী বিভিন্ন সরকার মুসলমানদের পশ্চিমা সভ্যতার প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে জনগনের সামনে দার করাচ্ছে। নারী অধিকার আর নারী স্বাধীনতার বুলি আওড়ানো পশ্চিমা বিভিন্ন দেশে বোরকা, হিজাব ও আযান নিষিদ্ধের মতো কাজ বেড়েই চলেছে।
ইউরোপের ইসলাম বিদ্বেষী এই অবস্থানের কারনে ক্রমাগত যে প্রস্নটি বড় হয়ে শুনা যাচ্ছে তা হচ্ছে, পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থা কি আদৌ মানুষের ধর্মীয় অধিকার নিশ্চিত করতে পেরেছে? তবে বোরকা ও নেকাব নিষিদ্ধ করাকে ইসলাম বিরোধী পদক্ষেপ হিসেবে না দেখে, একে কেবলই নিরাপত্তার স্বার্থে বিবেচনা করার যুক্তি দেখাচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো।
মুসলিম মহিলাদের জন্য বোরকা নিষিদ্ধ করা নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। বিভিন্ন মুসলিম প্রধান দেশেও বোরকা ও নেকাব বিভিন্ন কারণে নিষিদ্ধ। পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কয়েকটি দেশে বোরকা নিষিদ্ধ করার কারণে অনেকেই বিস্মিত এবং বিষয়টি বড় বিতর্ক সৃষ্টি করেছে সেসব দেশে। এর মূলকারণ হিসেবে সরকারগুলুর যুক্তি হচ্ছে জিহাদি হামলায় যে ধরণের বোমা বা বিস্ফোরক ব্যবহৃত হয় বোরকার নীচে তা লুকিয়ে রাখা যায় খুব সহজে।
আজকে আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বোরকা ও হিজাব নিষিদ্ধের ইতিহাস জানার চেষ্টা করব।
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ফ্রান্সই প্রথম আইন করে বোরকা ও নেকাব নিষিদ্ধ করে। ২০১০ সালে ফ্রান্স যখন প্রথম ‘মুখ ঢাকা পোষাক’ নিষিদ্ধ করে তখন তা ইউরোপে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি করে। ফ্রান্সের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের সঙ্গে এটিকে সংঘাতপূর্ণ বলে বর্ণনা তখনকার সরকার প্রধান প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি নিষিদ্ধ করে বোরকা ও নেকাব। ফ্রান্সে কেবল বোরকা নয়, মুখ ঢাকা যে কোন পোশাক, মুখোশ, হেলমেট বা হুড – যা পরিচয় গোপন রাখতে সহায়তা করে, তা নিষিদ্ধ। ফ্রান্সে প্রায় ৫০ লাখ মুসলমান বসবাস করে। যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬ শতাংশ। পশ্চিম ইউরোপের মধ্যে ফ্রান্সেই সবচেয়ে বেশি মুসলিম। বোরকা বা নেকাব পরলে জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে দেশটিতে। বোরকা পড়লে ৩২ হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্ত জরিমানার বিধান আছে আইনে।
ফ্রান্সের পথ ধরে ২০১১ সালে বেলজিয়ামেও বোরকা ও নেকাব নিষিদ্ধ করা হয়। দেশটিতে কোনো নারী তার পুরো মুখ কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে পারবে না বলে আইন করা আছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো এর বিরুদ্ধে নিন্দা জানালেও তেমন কোনো লাভ হয়নি। সে দেশের সরকার জানিয়েছে নিরাপত্তার স্বার্থে কোন ব্যক্তি বোরকা, হিজাব কিংবা মুখ ঢেকে রাখে এমন পোশাক পরতে পারবে না।
নেদারল্যান্ডসে ২০১৫ সালে আইন করে বোরকা নিষিদ্ধ করা হয়। প্রথমে নেদারল্যান্ডসের স্কুলগুলোতে ২০০৭ সালে বোরকা বা মুখ ঢাকা নিকাব নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা পরে অন্যান্য প্রকাশ্য স্থানেও কার্যকর করা হয়। জনসন্মুখে, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হসপিটাল কিংবা সরকারি অফিস, পার্ক ইত্যাদি জায়গায় কোন নারী ইসলামিক পোশাক পরতে পারবে না এই আইনটি নেদারল্যান্ডসে কার্যকর হয় ২০১৯ সালের ১ আগস্ট।
স্পেনের বার্সেলোনা শহর কর্তৃপক্ষ সেখানে বোরকা নিষিদ্ধ করেছে। পাবলিক প্লেস, রাস্তা, পার্ক কিংবা সরকারি প্রতিষ্ঠানে কোনো নারী বোরকা পরতে পারবে না। আইন ভঙ্গ করলে কারাদণ্ড ছাড়াও মোটা অংকের জরিমানার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
সুইজারল্যান্ডের প্রায় ২৬টি শহরে বোরকা নিষিদ্ধ। কেউ জনসম্মুখে বোরকা পরলে ৯ হাজার ইউরো পর্যন্ত জরিমানার বিধান রেখেছে দেশটি।
ইতালির বেশ কয়েকটি শহরে নিকাব নিষিদ্ধ। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর নোভারা কর্তৃপক্ষ সেখানে আইন করে বোরকা নিষিদ্ধ করেছে। ‘৭০-এর দশকেই মুখ ঢেকে রাখা সব ধরনের ইসলামিক পোশাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ইতালি।
ব্রিটেনে কোনো ইসলামি পোশাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে স্কুলগুলোতে নির্দিষ্ট পোশাক পরতে হয়। ২০০৭ সালে বেশ কয়েকটি মামলার পর স্কুল কর্তৃপক্ষ ঠিক করে স্কুলে কেউ বোরকা বা নেকাব পরতে পারবে না।
২০১৮ সালের ৩১ মে ডেনমার্কে বোরকা, হিজাব, নিকাব নিষিদ্ধ করা হয়। দেশটির মোট জনসংখ্যার ৫.৪% মুসলিম। সংখ্যায় যা প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ। সরকারি নির্দেশনায় জানানো হয় জনসম্মুখে কোনো নারী ইসলামী লেবাস পড়তে পারবে না। এতে নাকি সে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা বাধাগ্রস্ত হয়।
জার্মানির বাডেন ভুর্টেমব্যার্গ রাজ্যের স্কুলে বোরকা-নিকাব নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ প্রশাসন জানিয়ে দিয়েছে, স্কুলে বোরখা বা নিকাব পরে যাওয়া যাবে না। এমন কিছু পরা যাবে না, যা মুখ ঢেকে রাখে। এছারা জরিপে দেখা গেছে, প্রায় তিন-চতুর্থাংশ জার্মানও প্রকাশ্যে বোরকাধারী মহিলাদের দেখতে চায়না।
ইউরোপ ছাড়াও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বোরকা নিষিদ্ধ। ২০১৫ সালে দুটি বোমা হামলার পর নারীদের মুখ ঢাকা পোশাক নিষিদ্ধ করেছে চাদ। ক্যামেরুনেও একই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বর্তমানে দেশটির উত্তরাঞ্চলে বোরকা ও নেকাব নিষিদ্ধ। আর তাদের পথ অনুসরণ করে কঙ্গো, গ্যাবন ও নাইজারের কিছু এলাকায় নিষিদ্ধ হয়েছে বোরকা ও নেকাব। মূলত উগ্রবাদী গোষ্ঠী বোকো হারামের কার্যক্রম বেশি থাকায় আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বোরকা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছারা আফ্রিকার ৯৯ শতাংশ মুসলিম ধর্মাবলম্বীর দেশ মরক্কোতে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে বোরকার উৎপাদন, আমদানি ও বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়৷ তবে এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি দেশটির সরকার৷ উগ্রবাদী আক্রমণ মোকাবেলাই হচ্ছে এর প্রধান কারণ বলে জানায় আফ্রিকার মুসলিমপ্রধান দেশটির সরকার।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে এশিয়ার মুসলিমপ্রধান দেশ তাজিকিস্তান বোরকা ও হিজাব নিষিদ্ধ করে৷ ২০১৯ সালে খ্রিস্টানদের ইস্টার সানডের প্রার্থনা চলাকালে গির্জায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় শ্রীলঙ্কায় নিহত হন অন্তত ২৫৩ জন। ঘটনার এক সপ্তাহ পরেই মুখ ঢাকা পোশাক নিষিদ্ধ করে দেশটির সরকার।
তবে বোরকা ও নেকাব নিষিদ্ধের বাইরে উল্টো পথেও হেঁটেছে আবার অনেক দেশ। তুরস্কে বহু দশক ধরে বোরকা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু ২০১৩ সালে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় দেশটির ক্ষমতাসীন এ কে পার্টি। তিউনিসিয়াও ২০১১ সালে মাথা এবং মুখ ঢাকার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। সিরিয়াতেও বোরকা পড়ার বিরুদ্ধে নানা রকম নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু ২০১১ সালে সেখানে শিক্ষকদের নিকাবে মুখ ঢাকার অনুমতি দেয়া হয়।