বিশ্বাসের ঘাতক বা বিশ্বাসঘাতক, যে বিশ্বাসকে হত্যা করেছে। শত্রু কখনো বিশ্বাস ঘাতক হয় না, বিশ্বাসঘাতকতা করে কেবল বন্ধুরাই!তাই এই বিশ্বাসঘাতকতার ব্যাপারটি কখনো দূরের কারো কাছ থেকে নয় বরং কাছের মানুষদের হাত ধরেই আসে। যার উপর বিশ্বাস করেছিলেন।সেই যখন নিজ স্বার্থে ঘাতক হয়ে ওঠে, তখনই ঘটে বিশ্বাসঘাতকতা।
ক্ষুদ্র ক্ষেত্রে এমন বিশ্বাসঘাতকতা সমাজের প্রচলিত ভারসাম্য নষ্ট করে। জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে যদি বিশ্বাসঘাতকতা সংগঠিত হয়, জাতির সাথে যে বেঈমানি করে সে নিক্ষিপ্ত হয় ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে।
নিজ সংগঠন, নিজ দল বা গোত্র সর্বোপরি দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার লজ্জাজনক কিংবা ভয়াবহ উদাহরণ মানুষই সৃষ্টি করেছে। এই পৃথিবীতে এমন কিছু বিশ্বাসঘাতক জন্মে ছিল, যাদের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য সেই রাষ্ট্র বা জাতিকে অনেক চড়া মূল্য দিতে হয়েছিল। দেশে দেশে এমন কিছু কুখ্যাত বিশ্বাসঘাতকদের জন্য পাল্টে গিয়েছিল পৃথিবীর ইতিহাস।
মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাস(Marcus Junius Brutus)ঃ
ইউরোপের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকা কাউকে যদি কোনো বিশ্বাসঘাতকের নাম বলতে বলা হয়, তবে তার মনে যে নামটি সবার আগে ভেসে উঠবে তা হলো মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাস।
এখনও ব্রুটাসের দেশ ইতালিতে কেউ কারও সঙ্গে বেইমানি করলে ক্ষোভ প্রকাশের জন্য ল্যাটিন ভাষায় বলা হয়, 'ও তুমিও ব্রুটাস!' উইলিয়াম শেকসপিয়র সহ বহু নামিদামি কবি, সাহিত্যিক এবং গবেষকদের লেখায় বারবার উঠে এসেছে বিশ্বাসঘাতক ব্রুটাসের নাম।
ব্রুটাস ছিলেন প্রাচীন রোমের জেনারেল এবং তৎকালীন নগর রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়ক জুলিয়াস সিজারের প্রথম জীবনের বন্ধু। তরুণ বয়সে ব্রুটাস সাইপ্রাসে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। চাকরির পাশাপাশি উচ্চ হারে সুদের ব্যবসা করে রাতারাতি ধনী বনে যান ব্রুটাস। এরপর রোমের সরকার ব্যবস্থায় জুলিয়াস সিজারের পক্ষে সিনেটর হিসেবে কাজ শুরু করেন।
প্রাচীন রোমের প্রচলিত গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা বাদ দিয়ে জুলিয়াস সিজার যখন নিজেকে একনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান এবং যাবতীয় ক্ষমতা তার হাতের মুঠোয় নিয়ে আসার চেস্টা করেন তখন সিনেটররা ক্ষুব্ধ হন এবং তারা যেকোনো মূল্যে এই ব্যবস্থা ঠেকানোর জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।
তখন সিনেটররা সিজারকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে এবং এই পরিকল্পনার মূল হোতা ছিলো ব্রুটাস। সিজার আর ব্রুটাসের সম্পর্ক বন্ধুর মতো ছিল, এমনকি ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার পরিকল্পনায় ব্রুটাস সিজারকে সমর্থনও দিয়েছিলো।
শেষ পর্যন্ত সেই ব্রুটাসের নেতৃত্বে অন্যান্য সিনেটররা, রাজদরবারে সিজারকে একের পর এক ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে।
একের পর এক ছুরির আঘাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরতে সিজার দেখতে পেলেন তারই অনুগ্রহে বেঁচে যাওয়া ব্রুটাসও তাকে আঘাত করছে তখন মৃত্যুর আগ মুহূর্তে শুধু একটি কথাই বললেন, 'ও তুমিও ব্রুটাস'!
এফিয়াল্টস(Ephialtes)ঃ
খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০ সালে ৩০০ জন সৈন্য নিয়ে পার্সিয়ান রাজা জেরেক্সের বিশাল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন লিওনাইডাস। স্পার্টান রাজা লিওনাইডাসের যুদ্ধকৌশলের মাধ্যমে মাত্র ৩০০ জন স্পার্টান যুদ্ধা আটকেদেয় জেরেক্সের বিশাল বাহিনীকে।
কিন্তু লিওনাইডাসের বিশ্বস্ত স্পার্টান এফিয়াল্টস পার্সীয়ান রাজার সাথে হাত মিলিয়ে তাদের স্পার্টান যোদ্ধাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। এফিয়াল্টস পার্সীয়ান সৈন্যদের একটি গোপন পথ দেখিয়ে দেয়, যেটা দিয়ে সহজেই স্পার্টানদের পিছন দিক দিয়ে আক্রমণ করা যায়।
পার্সীয়ান বাহিনীর উভয়মুখী আক্রমণে স্পার্টান রাজা লিওনাইডাস সহ অন্যান্য যোদ্ধারাও মৃত্যুর মুখে পতিত হন। যুগে যুগে এফিয়েলটস তাই ইতিহাসে বেঈমান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
জুডাস ইস্কারিয়ট(Judas Iscariot)
যীশু খ্রীষ্টের সাথে জুডাস ইস্কারিয়টের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের কাছে ঘৃণিত নাম জুডাস ইস্কারিয়ট। মাত্র ৩০ রৌপ্য মুদ্রার বিনিময়ে জুডাস যীশুকে রোমান সৈন্যদের হাতে ধরিয়ে দিতে সহায়তা করে।
রোমান সৈন্যদের সাথে চুক্তি ছিল জুডাস লাস্ট সাপারের পরে যীশুর গালে চুমু খাবে। জুডাসের চুমো দিয়েই যীশুকে সনাক্ত করা হবে। ঐ চুমুটা ছিল একটা ইশারা মাত্র এবং লাস্ট সাপারের পরে যখন জুডাস , যীশুর গালে চুমু খায় তখনই রোমান সৈনিকরা যীশুকে চিনতে পারে এবং যীশু কে আটক করে।
আলফ্রেড রেড(Alfred Redl)
ব্যক্তিজীবনে অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী আলফ্রেড রেড নামের বিশ্বাসঘাতক ছিলেন অস্ট্রিয়ার কাউন্টার ইন্টেলেজিন্সির প্রধান। এসময় তিনি পরিচিতি পান একজন ঝানু গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে। কিন্তু তখনো পর্যন্ত কেউ জানত না যে তিনি মূলত একজন ডবল এজেন্ট হয়ে কাজ করছেন।
১৯০৩ থেকে ১৯১৩ পর্যন্ত সে একজন ডবল এজেন্টের কাজ করেছিলো।১ম বিশ্বযুদ্ধের সময় সে অস্ট্রিয়ার, সাইবেরিয়া আক্রমণের পরিকল্পনা রাশিয়ানদের হাতে তুলে দিয়েছিল।
যার মূল্য দিতে হয়েছিলো অস্ট্রিয়ার ৫ লক্ষ্য মানুষের জীবন দিয়ে। সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে তথ্য ফাঁস করে দেয়া এছাড়াও সোভিয়েত সেনাবাহিনী সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে অস্ট্রিয়ান সেনাবাহিনীকে বিব্রত করেন রেড।
শুধু তাই নয়, মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সোভিয়েতে নিয়োজিত অস্ট্রিয়ান গুপ্তচরদের কথাও ফাঁস করে দেন এ বিশ্বাসঘাতক। যখন তার এই বিশ্বাসঘাতকতার কথা প্রকাশ হয়ে যায় তখন সে নিজে আত্মহত্যা করে।
ভিডকুন কুইসলিং(Vidkun Quisling)
বাংলা ভাষায় মীরজাফর নাম বা শব্দটি যেভাবে ব্যবহৃত হয়, ইংরেজি ও নরওয়ের ভাষায়ও কুইজলিং নাম বা শব্দটি সেভাবে ব্যবহৃত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের খলনায়ক ভিডকুন কুইসলিং ছিলেন নরওয়েজিয়ান আর্মী অফিসার এবং রাজনীতিবিদ।
কুইসলিং নরওয়ের ক্ষমতাসীনদের সরিয়ে নিজেই ক্ষমতা দখলের জন্য হিটলারের সাথে হাত মিলিয়ে জার্মানদের নরওয়ে দখলের জন্য যাবতীয় সামরিক তথ্য হিটলারের কাছে পাচার করেন।
হিটলারের সমর্থনে কুইজলিং রাজধানী ওসলোর ৫০ কিলোমিটার দূরে নিজের ঘাঁটি গড়েন এবং প্রচার করতে থাকেন যে, নরওয়ের ক্ষমতাসীনরা পালিয়েছে। পরবর্তীতে জার্মানরা নরওয়ে দখল করে নিলে কুইজলিং তার নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠনের ঘোষণা দেন এবং নরওয়ের সেনাবাহিনীকে জার্মানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা প্রতিরোধ বন্ধের নির্দেশ দেন।
কিন্তু বিশ্বযুদ্ধে জার্মানের হারের সাথে সাথে বিপদে পড়ে যায় কুইজলিং। ১৯৪৫ সালে জার্মানদের আত্মসমর্পণের পরে নরওয়ের জনগণ তাকে বিচারের সম্মুখীন করে এবং তার ফাঁসি হয়।
রসেনবার্গ দম্পতি
আমেরিকান দম্পতি জুলিয়াস রসেনবার্গ এবং ইথেল রসেনবার্গ আনবিক ও পারমানবিক বোমা নিয়ে গবেষণায় যুক্ত ছিলেন।
পরবর্তীতে দেশের স্বার্থ ত্যাগ করে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে আমেরিকান পারমানবিক প্রযুক্তি সম্পর্কে অনেক গোপন তথ্য রাশিয়ানদের কাছে পাচার করে। ১৯৫৩ সালে বৈদ্যুতিক চেয়ারে আটকিয়ে আমেরিকার এই ঘৃণিত রসেনবার্গ দম্পতিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
মীর জাফর আলী খান
ইতিহাসের পাতায় সর্বকালের কুখ্যাত, বিশ্বাসঘাতকের প্রতিশব্দ হিসেবে ঘৃণাভরে উচ্চারিত হয় মীর জাফরের নাম। মীর জাফর আলী খানের বিশ্বাসঘাতকতায় পলাশী যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে পরাজিত হন নবাব সিরাজউদদৌলা, যার পরিণতিতে দীর্ঘ ২০০ বছর ব্রিটিশ শাসনে নিষ্পেষিত হয় এই উপমহাদেশ।
মূলত মীর জাফর ছিল আরব থেকে আসা এক বেদুইন। নবাব আলীবর্দি খান তাকে বকশী পদে নিয়োগ দেন। আলীবর্দী মারা গেলে সিরাজউদ্দৌলার ক্ষমতা গ্রহণকে মীর জাফর ভালভাবে মেনে নিতে পারেনি।
নবাবের খালাতো ভাই শওকত জং কে মসনদে বসানোর চেষ্টা করে মীর জাফর। এই তথ্য ফাঁস হয়ে গেলে নবাব তাকে ‘বকশী’ পদ থেকে সরিয়ে দেন। কিন্তু মীর জাফর সেনাপতির দায়িত্বে থেকে যান।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে মীর জাফর তার অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণ করেন নির্লজ্জ বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে।
ইংরেজরা যখন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করতে থাকেন, তখন গোপনে মীর জাফর ইংরেজদের পক্ষ নেন এবং নিজে নবাবের সিংহাসনে বসার আয়োজন করতে থাকেন।
এই চক্রান্তের কারণে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজ আক্রমণের মুখে মীর জাফরের অনুগত সেনাবাহিনীর একটি অংশ নবাবের বদলে ইংরেজদের পক্ষ নেয় এবং পরাজিত করেন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে। পলাশীর যুদ্ধে নবাবের পরাজয়ের মাধ্যমে কার্যত পুরো উপমহাদেশে চালু হয়ে যায় ব্রিটিশ শাসন।
বিশ্বাসঘাতকদের সর্দার মীর জাফর পবিত্র কুরআন শরীফ মাথায় রেখে নবাবের সামনে তার পাশে থাকবেন বলে অঙ্গীকার করে।কিন্তু তারপরও বেঈমানী করেছিল। পরবর্তীতে ১৭৫৭ সালে মীর জাফরকে নবাব করা হলেও বাস্তবে তিনি ছিলেন ইংরেজদের আজ্ঞাবহ হাতের পুতুল। ১৭৬০ সালে তার জামাতা মীর কাসেম তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। পরবর্তীতে তিনি দুরারোগ্য কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে ৭৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। আজও গালি বা বিশ্বাসঘাতকের প্রতিশব্দ হিসেবে বেঁচে আছে সর্বকালের কুখ্যাত বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরের নাম।
খোন্দকার মোস্তাক আহমদঃ
স্বাধীন বাংলার ইতিহাসে জঘন্যতম একটি নাম খন্দকার মোশতাক আহমেদ। নামটি বাংলাদেশের মানুষের কাছে ঘৃণিত ও নিন্দিত। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী ছিল খোন্দকার মোস্তাক।কিন্তু রাষ্ট্রপতি হওয়ার খায়েশে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন।খোন্দকার মোস্তাক যার পরিনতিতে সপরিবারে হত্যা করা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তার পরোক্ষ মদদে কিছু সেনা কর্মকর্তা কর্তৃক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হয়। তারপর মোশতাক আহমেদ নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। এই পদে তিনি মাত্র ৮৩ দিন ছিলেন।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ পর্যন্ত তিনি অঘোষিতভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তারই সেনাপ্রধান কর্তৃক পাঁচ বছর কারাভোগ শেষে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি থাকার পর লোকচক্ষুর অন্তরালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। মানুষের কাছে বাংলাদেশের মীরজাফর বা বিশ্বাসঘাতক হিসেবেই তিনি বিশেষভাবে পরিচিত।